যে লাভের আশায় বেসিক ব্যাংক নিতে চায় সিটি ব্যাংক!



দুর্বল ব্যাংকের দায়িত্ব নিলে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের পক্ষ থেকে আর্থিক এবং নীতি সহায়তার যে ঘোষণা এসেছে, সে কারণেই দুর্দশাগ্রস্ত বেসিক ব্যাংকের দায়িত্ব নিতে চায় বেসরকারি খাতের সিটি ব্যাংক।


সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “স্বতঃপ্রণোদিত একত্রীকরণ হলে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের নীতি সহায়তা যেহেতু অনেক বেশি, তাই সবল ব্যাংক হিসেবে কোনো দুর্বল ব্যাংককে একীভূত করা যায় কি-না, তা আমরা খতিয়ে দেখছি।”


দুর্বল ব্যাংককে সবলের সঙ্গে একীভূত করার প্রক্রিয়ায় সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে বৈঠক করেন সিটি ব্যাংকের চেয়রাম্যান আজিজ আল কায়সার। সেখানেই বেসিক ব্যাংক অধিগ্রহণের বিষয়ে আলোচনা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকও সিটি ব্যাংকের এ আগ্রহকে সমর্থন দিচ্ছে। 


দেশে ব্যাংকের সংখ্যা কমিয়ে আনতে গত কয়েক বছর ধরেই তাগিদ দিয়ে আসছেন অর্থনীতিবিদরা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও ব্যাংক খাতের সংস্কারের বিষয়টি তাদের সর্বশেষ নির্বাচনি ইশতেহারে রেখেছে।


সেই ধারাবাহিকতায় দুর্বল ও ঝুঁকিতে থাকা ব্যাংকগুলোকে সবলের সঙ্গে একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আড়াই বছরের ‘রোডম্যাপ (কর্ম কৌশল)’ ঠিক করার পাশাপাশি ব্যাংকগুলোকে এক বছর সময় দিয়ে ‘প্রম্পট কারেক্টিভ অ্যাকশন’ বা পিসিএ নীতি ঘোষণা করা হয়েছে।


ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার, মূলধনের পর্যাপ্ততা, নগদ অর্থের প্রবাহ, ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের তথ্য বিবেচনায় নিয়ে বিভিন্ন সূচকের মানদণ্ডে আর্থিক স্বাস্থ্য নিরূপণ করা হয়।


কাঙ্ক্ষিত মানদণ্ডের নিচে থাকা ব্যাংকগুলোকে দুর্বল হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। র্দুবল ব্যাংক টেনে তুলতে শেষ পদক্ষেপ হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার পরিকল্পনা রেখেছে।


গত ৪ এপ্রিল ব্যাংক একীভূত করার বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেখানে বলা হয়, দুর্বল ব্যাংকের দায়িত্ব নিলে গ্রহীতা ব্যাংকের ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণ, সিআরআর, এসএলআর, এলসিআর এর বিপরীতে বিভিন্ন হারে যে প্রভিশন রাখতে হয়, তাতে ছাড় দেওয়া হবে তিন বছরের জন্য।


গ্রহীতা ব্যাংকের কার্যক্রম নির্বিঘ্ন রাখা এবং জনস্বার্থে ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা রক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়ে নীতিমালায় বলা হয়, দীর্ঘ মেয়াদি বন্ড কেনার মাধ্যমে নগদ সহায়তা, মূলধন বৃদ্ধির জন্য শেয়ার ইস্যু, পারপেচুয়াল বন্ড এবং সাবঅর্ডিনেটেড বন্ড ইস্যু করতে গ্রহীতা ব্যাংককে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে সহায়তা দেওয়া হবে।


দায়িত্ব নেওয়ার পরবর্তী তিন বছর দুর্বল ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন গ্রহীতা ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদনে যুক্ত হবে না। অর্থাৎ আর্থিক প্রতিবেদন পৃথক আকারে দেখানো যাবে। এর ফলে একীভূত হওয়ার পরও দুর্বল ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদনের কোনো প্রভাব পড়বে না গ্রহীতা ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদনের ওপর।


এর বাইরে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে যে কোনো বিষয়ে সুবিধা নিতে পারবে গ্রহীতা ব্যাংক, তাও বলা হয়েছে নীতিমালায়।


এমন ঘোষণার পর সিটি ব্যাংকের আগ্রহ বেড়েছে জানিয়ে মাসরুর আরেফিন বলেন, “যেটাই করি না কেন, আগে ওই দুর্বল ব্যাংক পুনর্গঠন করব এবং তিন বছর বা তার বেশি সময় পরে দুই ব্যালান্সশিট এক করব। এটাই আমাদের ইচ্ছা। পলিসিতে বলা আছে ব্যাংক পুনর্গঠনে তিন বছর সময় পাব।”


তিনি বলেন, “এই তিন বছর ভালো পথে গেলে আমি আশাবাদী, সময় আরও বাড়বে। দুর্বল ব্যাংকগুলো নিয়ে আমাদের বিশ্লেষণ চলছে। আপাতত এর বেশি কিছু বলতে পারছি না “


কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার মাস খানেক আগে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবুল হাশেমের সঙ্গে মার্জারের সম্ভাবনা নিয়ে বৈঠক করেন।


ওই বৈঠকে বেসিক ব্যাংককে রাষ্ট্রায়ত্ত অন্য কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার প্রস্তাব রাখা হয়। তবে একীভূত না করে তারল্য সহায়তা চাওয়া হয় বেসিক ব্যাংকের পক্ষ থেকে।


কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমানে বেসিক ব্যাংকের ১০৭টি শাখার মধ্যে ছয়টি ছাড়া বাকি সবগুলোই লাভজনক। খরচ কমিয়ে আনা, ঋণ বিতরণে লাগাম টানা, পুরনো ঋণের অর্থ আদায়ে জোর দেওয়ায় ব্যাংকটি অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে।


উচ্চ সুদের আমানত থাকায় ব্যাংকটি এখনো তারল্য সংকটে ভুগছে। দীর্ঘ মেয়াদী বন্ড সুবিধার আওতায় তারল্য সহায়তা দিলে বেসিক ব্যাংক এক বছরেই ‘লাভজনক’ হতে পারবে বলে গভর্নরের সঙ্গে সেই বৈঠকে ধারণা দেওয়া হয়।


বাংলাদেশ ব্যাংক প্রথমে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী বা অগ্রণীর সঙ্গে বেসিক ব্যাংককে একীভূত করার পরিকল্পনায় ছিল। ওই বৈঠকের এক মাস পরে রাষ্ট্রায়ত্ত বিডিবিএল (বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক পিএলসি) অধিগ্রহণের আগ্রহ দেখায় সোনালী ব্যাংক। সোমবার দুই ব্যাংকের পর্ষদ ওই মার্জারের প্রস্তাব অনুমোদন করেছে।


এ অবস্থায় এখন বেসিক ব্যাংককে সিটি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।


কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেসিক ব্যাংকের তারল্য সংকট কাটাতে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন। বর্তমান সুদে এই অর্থ পেলে পুরনো দায় মিটিয়ে ব্যাংকটি লাভজনক অবস্থানে ফিরতে পারবে বলে মনে করছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারাও।


বেসিক ব্যাংক একীভূত হওয়ার আলোচনার মধ্যে গত ৩১ মার্চ ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিছুর রহমানের মেয়াদ শেষ হয়। নতুন করে কাউকে এখনো নিয়োগ দেয়নি সরকার।


গত ৪ এপ্রিল থেকে ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন ব্যাংকটির উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু মো. মোফাজ্জল।


বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “মার্জার ইস্যুতে সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংক আমাকে ডাকেনি। এ বিষয়ে কোনো কথা আমার সঙ্গে হয়নি।”


সোমবারের বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ব্যাংক একীভূতকরণের নীতিমালা প্রকাশ করা হয়েছে। এখনো স্বেচ্ছায় একীভূত হতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংক মধ্যস্থতা করতে পারবে নীতিমালা অনুযায়ী।


“অনেক ব্যাংক নিয়েই আলোচনা চলছে। কে কার সঙ্গে যাবে তা চূড়ান্ত হবে দুই ব্যাংকের পর্ষদের সিদ্ধান্তের পর। তারপরও বেটার অপশন (ভালো সুযোগ) সব সময় বিবেচনায় থাকবে।”


মার্জারের প্রক্রিয়া শুরুর পর প্রথম উদ্যোগ হিসেবে দুর্দশায় থাকা পদ্মা ব্যাংক শরীয়ভিত্তিক ব্যাংক এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে সমঝোতা চুক্তি করেছে।

সূত্র: বিডিনিউজ ২৪ ডট কম।

Post a Comment

0 Comments